কার্গিল দিবসের ইতিহাস

 ১৯৯৯ সালে মে-জুলাই মাসে ভারত পাকিস্তানের মধ্যে হওয়া এক উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ হল কার্গিল যুদ্ধ।

কার্গিল লাদাখ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের কার্গিল জেলার একটি শহর। খুব বেশী জনবহুল নয়। কিন্ত অনেক গুরুত্বপূর্ন জায়গা।
তো ব্যাপার হলো ১৯৯৮ সালে ভারত পাকিস্তান উভয় দেশেই নিজেদের পরমাণু পরীক্ষা সফল ভাবে সম্পন্ন করে। তো দুটি পাশাপাশি পারমাণবিক শক্তিধারি দেশ থাকলে বাদ-বিবাদ তো হবে। তাই হাওয়া একটু একটু গরম হতে শুরু হয়েছিল। অবশ্য ১৯৭১ এ ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পর 
শিমলা এগ্রিমেন্ট থেকে ভারত পাকিস্তানের মধ্যে সেরকম বড়ো রূপে কোনো সংঘর্ষ হয়নি।
হঠাৎ দুই দেশের মধ্যে এইধরণের গরম আবহাওয়া দেখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয় ২১শে ফেব্রুয়ারি , ১৯৯৯ সালে লাহোরে গিয়ে তাদের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সঙ্গে লাহোর ডিক্লারেসনে সই করেন। যাতে দুই দেশের মধ্যে শান্তি বজায় থাকে আর তারা প্রতিদ্বন্দ্বী না হয়।
কিন্তু তার ঠিক তিনমাস পর এরকম ভাবে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ লাগবে তা কেউ বিশ্বাস করতে পারেনি।

তো কি হয় সেই বছর ফেব্রুয়ারি থেকেই কার্গিল ও তার আশেপাশের অঞ্চলগুলো যেমন বাটেলিক, দ্রাস ইত্যাদি জায়গা দিয়ে পাকিস্তানি অনুপ্রবেশকারিরা/সেনারা লাইন-অফ-কন্ট্রোল(LOC) পার হয়ে‌ ভারতে ঢুকতে শুরু করে তাদের অপারেশন বদ্রর মাধ্যমে। তাদের মুল উদ্দেশ্য ছিল NH1 হাইওয়ে যেটা 'শ্রীনগর' কে ‘লে’ র সঙ্গে যুক্ত করছে সেটি দখল করা। এই রাস্তা কার্গিলের মধ্য দিয়ে যায়। আর কার্গিল LOC র খুব কাছে হওয়ার যুদ্ধ করার জন্য স্টার্টিজিক সুবিধাও ছিল। এছাড়াও এটি দখল করলে তারা সিয়াচেন যাবার রাস্তাও বন্ধ করতে সক্ষম ছিল।

পাকিস্তানের এইসব কু-কাজ ‌আগের থেকে জানতে না পারা ভারতের একপ্রকার ইনটেলজেন্স ব্যর্থতা বলা যায়। সেনাদের কাছেও তখন এটি জানা দুঃসাধ্য ছিল, কারন শীতের সময় তাপমাত্রা সেখানের -২৫° সেলিয়াসের নিচে চলে যায়, তাই সেই সময় খুব কমসংখ্যক ভারতীয় সেনা সেখানে নিয়োগ ছিল। কিন্তু পরে মে মাসের দিকে যখন অনুপ্রবেশকারীরা আমাদের সেনার একটি পেট্রোলিং দলের উপর আচমকা হামলা করে তখন থেকে ব্যাপারটা সামনে উঠে আসতে লাগলো। প্রথমে ভাবা হয়েছিল যে এটি কোনো একটি ছোট-খাটো জিহাদী দলের কাজ কিন্তু সময়ের সাথে সাথে জিনিসটা পরিষ্কার হয়ে উঠে যে কিরকম মাত্রায় তারা প্ল্যানিং করছে এক বিরাট আক্রমনের জন্য।
পুরো ব্যাপারটি স্পষ্ট হওয়ার পর কাউন্টারে ভারতীয় সরকার 
অপারেশন বিজয়ের মাধ্যমে প্রায় ২ লাখ সৈন্য কে কাশ্মীরে সক্রিয় করেন। এবং ছোট ছোট গ্রুপের মাধ্যমে পাকিস্তানি অনুপ্রবেশকারীদের সঙ্গে যুদ্ধে মোতায়েন করা হয়।
কিন্তু পাহাড়ি যুদ্ধে সৈনিক সংখ্যা খুবএকটা বেশী প্রভাব ফেলতে পারেনা। পাকিস্তানি সেনা কমসংখ্যক হয়ে করেও উচ্চতার কারনে যুদ্ধে অনেক সুবিধায় ছিল। ভারতীয় অনেক জওয়ানরা মারা যেতে থাকে এই কারনে।
তাই জওয়ানদের ব্যাক-আপ দেওয়ার জন্য ভারতীয় বায়ুসেনা অপারেশন 
সফেদ সাগর (Safed Sagar) শুরু করল। অবশ্য সরকার থেকে কড়া নির্দেশ ছিল যেন আমাদের কোনো বিমান যেন LOC পার না করে। পরে এই সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য বিশ্ব-রাজনীতিতে অনেক লাভদায়ক হয়েছিল।

প্রথমবার এত উচ্চতায় (প্রায় ৪০০০ - ৫০০০ মি:) কোনো বায়ুযুদ্ধ ঘটছিল। খারাপ আবহাওয়া, বাজে ভৌগলিক অবস্থানের কারনে বায়ুসেনাদের জন্য যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া অনেক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। ফ্রান্স থেকে কেনা মিরাজ 2000 জেট বিমান এই পাহাড়ি যুদ্ধে ভারতীয় এয়ারফোর্সের অনেক সাহায্য করেছিল (উল্লেখ্য এই বিমান কেনার জন্য বিরোধী নেতারা খুব সমালোচনা করেছিল রাজীব গান্ধীর)।
ভারতীয় নেভিরাও কম যায়নি তারা করাচী বন্দরকে আটকে ফেলেছিল। পাকিস্তানের সামুদ্রিক বাণিজ্য পুরো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সেসময়।শেষে পাকিস্তান প্রধানমন্ত্রী বলতে বাধ্য হয়েছিল যে পাকিস্তানের মাত্র আর ছয় দিনের জ্বালানি পড়ে থাকবে যদি তারা ভারতের সঙ্গে পুরোপুরি যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে যায় এইমুহূর্তে।

আস্তে আস্তে ভারতীয় স্থলসেনা ও বায়ুসেনাদের পরাক্রমে ভারত পাকিস্তানের অনেকগুলি ক্যাম্পে জয়লাভ করে। প্রায় দুইমাস যুদ্ধের পর পাকিস্তানি অনুপ্রবেশকারিদের দখলে থাকা জায়গার ৭৫ থেকে ৮৫ শতাংশ জায়গা ভারত নিজের কন্ট্রোল ফিরে পায়।

যুদ্ধের কারনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী আমেরিকার কাছে সাহায্যের জন্যও যায় কিন্তু রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটন পাকিস্তানের আবেদন কে ফিরিয়ে দেয়, বলে যতক্ষণনা পাকিস্তান নিজের সেনা সরাচ্ছে ততক্ষণ তারা এব্যপারে কিছু করবেনা। তারপর ৪ই জুলাই প্রধানমন্ত্রী শরীফ রাজী হয়ে যায় নিজেদেরকে সেনাকে ভারত থেকে সরানোর জন্য। কিন্তু এই যুক্তিতে তাদের সেনা আর একটি কট্টরপন্থী দল সহমত হয়নি। তাদের নিজেদের যুদ্ধ তারা চালিয়ে রাখতে চাই।

জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে ভারতীয় বাহিনী এয়ারফোর্সের সাথে নিজেদের অন্তিম আক্রমণ শুরু করে। দিবা-রাত্রি যুদ্ধ করে কার্গিলের পাশে দ্রাস অঞ্চলে পাকিস্তানি সেনাদের পরাজিত করে পুরো এলাকাটি নিজের দখলে আনে।

দ্রাস সাবসেক্টর হারানোর ফলে পাকিস্তান সেনা ২৬শে জুলাই যুদ্ধ থামিয়ে দেয়। অনেকগুলো ব্যাটল হেরে যাওয়া আর তার উপর আন্তর্জাতিক চাপের কারনে তারা নিজেদের বাহিনী LOC থেকে সরাতে বাধ্য হয়। সেখানে শান্তি আবার ফিরে আসে।

এই ২৬শে জুলাই আমরা ভারতীয়রা কার্গিল বিজয় দিবস হিসাবে পালন করি প্রতিবছর।

কার্গিল যুদ্ধের জন্য পাকিস্তানকে পুরো বিশ্বের কাছে সমালোচিত হতে হয়েছে । নিজেদের সেনা ভারতে ঢোকানোর জন্য তারা গোটা বিশ্বের কাছে নিন্দিত। পাকিস্তান নিজেদেরকে বাঁচানোর জন্য প্রচুর চেষ্টা চালায়। তারা এই যুদ্ধের কারন কাশ্মীরের পাকিস্তানপন্থী জঙ্গী ও ভারত বিচ্ছিন্নবাদী দলের দিকে ঠেলতে পুরোদমে প্রয়াস করেছিল কিন্তু শেষে

ব্যর্থ হয়। কারন এইরকম দুর্গম জায়গায় সুশিক্ষিত সৈন্য ছাড়া যুদ্ধ করা সূর্য পশ্চিমদিকে ওঠার সমান। এছাড়াও যুদ্ধের পর ফেলে যাওয়া তথ্য থেকেও প্রমাণ হয় যে পাকিস্তান আর্মি এই যুদ্ধে প্রত্যক্ষ ভাবে উপস্থিত ছিল।

এই ২৬শে জুলাই ভারতের সকল জওয়ান আর ভারতবাসীর কাছে প্রচুর গৌরবের দিন।

আমার স্কুলের একজন সিনিয়রের নাম কারগিল ছিল আমরা বন্ধুরা যখন তাকে নামের কারন জিজ্ঞাসা করি সে বলে তার বাবা কার্গিল যুদ্ধে অংশ নেওয়া এক সৈন্য ছিলেন। এই যুদ্ধের স্মৃতির জন্য তিনি নিজের প্রথম ছেলের নাম কারগিল রেখেছেন।

ধন্যবাদ !

Comments